একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ দর্শনযোগ

অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার কৃপায় অধ্যাত্মতত্ত্ব শুনে আমার মোহ দূর হল।১

তুমি সৃষ্টি ও লয়ের কথা বলেছ। তোমার অব্যয় মাহাত্ম্যও সবিস্তারে শুনেছি।২

তুমি তোমার স্বরূপ যা বললে তা সবই সত্য। তোমার ঐশি মূর্তি দেখবার জন্য আমর খুব ইচ্ছা হচ্ছে।৩

হে দয়াময়, তুমি যদি আমাকে তোমার ঐশি মূর্তি দেখবার উপযুক্ত মনে কর, তবে দয়া করে আমাকে তা দেখাও।৪

শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমার শত সহস্র বর্ণ দেখ।৫

আমার দেহ অশ্বিনীকুমার দ্বয়, বায়ুগণ, আদিত্যগণ, বসুগণ ও রুদ্রগণকে দেখ।৬

নিখিল জগত্‍ আমার মধ্যেই বিদ্যমান। তুমি আমার মধ্যে আরও যা দেখতে চাও চেয়ে দেখ।৭

চর্ম-চক্ষুতে আমাকে দেখা সম্ভব নয়। তাই তোমাকে জ্ঞান-চক্ষু দান করছি।৮

সঞ্জয় বললেন- হে মাহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ নিজের দিব্যরূপ দেখালেন।৯

অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের বহুমুখ, বহুচক্ষু এবং দিব্য-অস্ত্রশস্ত্র, দিব্য-অলংকারে শোভিত তাঁর অদ্ভুত মূর্তি দেখলেন।১০

অর্জুন দেখলেন- শ্রীকৃষ্ণ দিব্য বস্ত্র-মাল্যধারী এবং সুগন্ধে চর্চিত, সর্বাশ্চার্যময় ও অনন্ত।১১

এক হাজার সূর্য যদি আকাশে উদিত হয় তবে শ্রীকৃষ্ণের রূপের তুলনায় হাজার সূর্যের রূপ কিছু নয়।১২

অর্জুন নানাভাবে বিভক্ত বিশ্বকে শ্রীকৃষ্ণের দেহে একত্রিত দেখতে পেলেন।১৩

এই অদ্ভুত রূপ দেখে অর্জুন রোমাঞ্চিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে করজোড়ে বললেন।১৪

অর্জুন বললেন- হে দেব, আমি তোমার মধ্যে দেবগণ, ঋষিগণ, সর্পগণ, সর্বভুত ও পদ্মাসন ব্রহ্মাকে দেখতে পাচ্ছি।১৫

আমি তোমার অনন্ত উদর, অনন্ত নেত্র ও অনন্ত বাহু দেখছি। আমি তোমার বিশ্বরূপ দেখছি। তোমার এই রূপ আদিহীন, মধ্যহীন ও অনন্ত।১৬

তুমি চূড়া, গদা ও চক্রধারী। সর্বদিকে তুমি উজ্জ্বল। তেজে তুমি সূর্য ও অগ্নির তুল্য। তোমাকে নিরীক্ষণ করা সম্ভব নয়।১৭

তুমি সনাতন। তুমি অব্যয় অক্ষর। তুমি সর্বরক্ষাকারী ও জগতের আশ্রয়।১৮

তোমার অনন্ত বাহু, অনন্ত নেত্র। তোমার দুই চোখে সূর্য ও চন্দ্রের জ্যোতি। তোমার আগুনের মত উজ্জ্বল তেজে নিখিল জগত্‍ উত্তপ্ত হচ্ছে।১৯

তুমি একাই সমস্ত বিশ্ব ব্যাপিয়া আছ। তোমার উগ্ররূপ দেখে ত্রিলোক ভীত হচ্ছে।২০

ত্রিলোকবাসী ও দেবগণ ভয়যুক্ত হচ্ছে। ঋষিগণ ও সিদ্ধগণ তোমার স্তব করছেন।২১

বসুগণ, রুদ্রগণ, সিদ্ধগণ সকলেই তোমার রূপ দেখে অতিশয় মুগ্ধ হচ্ছে।২২

তোমার বহু মুখ, বহু চোখ, বহু বাহু, উরু দেখে ত্রিলোক ও আমি ভীত হয়েছি।২৩

তোমার নানাবর্ণযুক্ত তেজোদীপ্ত বিশ্বব্যাপী রূপ দেখে হৃদয়ে ভয় হচ্ছে।২৪


হে কৃষ্ণ, কালাগ্নিতুল্য তোমার করাল বদন ও দাঁত দেখে আমি ভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। আমার মনে বিন্দুমাত্র সুখও নাই।২৫

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, রাজগণ এবং আমাদের পক্ষেরও কত বীর দেখতে পাচ্ছি।২৬

তাঁরা অধীরভাবে তোমার মুখে প্রবেশ করছেন। তাঁদের কারও মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে, কেউবা তোমার ভয়ংকর দাঁতে আটকা পড়ে আছে।২৭

নদীর স্রোত যেমন সাগরে প্রবাহিত হয় এইসব বীরগণও সেইরূপ তোমার মুখে প্রবেশ করছে।২৮

পতঙ্গ আগুনে প্রবেশ করে মারা যায়। এই বীরগণও তেমনি মৃত্যুর জন্যই তোমার মুখে প্রবেশ করছে।২৯

তুমি জ্বলন্ত বদনে সকলকে ভক্ষণ করছ এবং সমস্ত বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে দগ্ধ করছ।৩০

হে উগ্ররূপী, তুমি কে? হে দেব, তুমি দয়া করে তোমার পরিচয় দাও। আমি তোমাকে প্রণাম করছি।৩১

শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমি লোকক্ষয়কারী ভয়ংকর কাল। তুমি তোমার শত্রুগণকে না মারলেও তাঁরা মারা যাবে।৩২

হে অর্জুন, উঠ। যুদ্ধ কর। যশ লাভ কর। আমি সকলকে মেরে রেখেছি। তুমি উপলক্ষমাত্র হও।৩৩

ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, জয়দ্রোথ- সকলকেই আমি মেরে রেখেছি। অতএব তুমি যুদ্ধ কর।৩৪

সঞ্জয় বললেন- শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে ভীত অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে করজোড়ে বললেন।৩৫

অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার নাম গান করে জগদ্বাসী পরিতুষ্ট। রাক্ষসগণ তোমার নামে দূরে পলায়ন করে। সিদ্ধগণ তোমার প্রণাম করে।৩৬

তুমি অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম। তুমি বিশ্বময়। তুমি ব্রহ্মারও পূর্ববর্তী। তুমি জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞাতব্য বিষয়।৩৭

হে প্রভু, তুমি আদিদেব। তুমি প্রধান পুরুষ, সমগ্র বিশ্ব তোমার মধ্যে বিরাজমান।৩৮

তুমি ব্রহ্মা, তুমি বরুণ, প্রপিতামহ প্রভৃতি- সব তুমি। হে অনাদি দেব, আমি তোমাকে নমস্কার করি।৩৯

আমি সামনে, পিছনে ও সবদিকে তোমাকে প্রণাম করছি। হে দয়াময়, তুমি অনন্ত, তুমি সকলের প্রভু।৪০

না জেনে বার বার "হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে সখা"- এইরূপ বলে তোমাকে কতই অবজ্ঞা করেছি।৪১

আহারের সময়, ঘুমের সময়, এবং আরও অনেক সময় আমি তোমাকে কত অবজ্ঞাই না করেছি। হে দয়াময়, তুমি আমার এই সকল দোষ ক্ষমা কর।৪২

তুমি বিশ্বের পিতা। তুমি শ্রেষ্ঠ গুরু। তুমি সকলের পূজ্য। বিশ্ব-সংসারে তোমার তুলনা মেলে না।৪৩

পিতা পুত্রের, বন্ধু বন্ধুর এবং স্বামী যেমন স্ত্রীর দোষ ক্ষমা করে, তুমিও সেইরূপ আমাকে ক্ষমা কর।৪৪

তোমার এই বিশ্বরূপ অপূর্ব। কিন্তু এটি দেখে আমার ভয় হচ্ছে। তুমি দয়া করে আমাকে তোমার পূর্বরূপ দেখাও।৪৫

হে প্রভু, তুমি বিশ্বরূপ ত্যাগ করে চতুর্ভুজধারী হয়ে আবার দেখা দাও।৪৬

শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে আমার দীপ্ত বিশ্বরূপ দেখালাম।৪৭

বেদ, যজ্ঞ, তপস্যা প্রভৃতি নানা-বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেও তুমি ছাড়া কেউ এর সন্ধান পায় না।৪৮

আমার উগ্ররূপ দর্শন করে তোমার যে ভয় হয়েছে তা এখন দূর হবে। তুমি এখন আমার পূর্বরূপ দর্শন কর।৪৯

সঞ্জয় বললেন- হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিজের পূর্বরূপ দেখালেন।৫০

অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তোমার এই নবরূপ দেখে আমি প্রকৃতিস্থ হলাম। আমার মন-প্রাণ প্রসন্ন হল।৫১

শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, আমার এই দুর্লভ রূপ দেখার জন্য দেবগণ সর্বদাই ইচ্ছা করেন।৫২

বেদপাঠ, যজ্ঞ কিংবা দান করে কেউ আমার এরূপ দর্শন করতে পারে না।৫৩

আমাতে যার একনিষ্ঠ ভক্তি হয়- সেই ব্যক্তি আমার রূপ দেখতে পারে। সেই ব্যক্তিই আমার প্রিয়।৫৪

হে অর্জুন, আমার ভক্ত অনাসক্তভাবে সিংসা ছেড়ে আমার কর্ম করেই আমাকে পেয়ে থাকে।৫৫
*একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত*

মন্তব্যসমূহ