ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ

অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় কাকে বলে তা বুঝিয়ে বল।১

শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে অর্জুন, এ দেহকে ক্ষেত্র বলে। যিনি ক্ষেত্রকে জানেন তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ।২

মনে রেখ- আমিই ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জানাই জ্ঞান।৩

ক্ষেত্রের স্বরূপ এবং ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভাব তোমাকে বলছি শোন।৪

পণ্ডিতগণ ক্ষেত্রতত্ত্ব নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বেদান্তে আবার ভিন্নভাবে এর বর্ণনা করা হয়েছে।৫

পঞ্চ মহাভূত, দশ ইন্দ্রিয়, রূপরসাদি, পঞ্চ বিষয় ও ইচ্ছাদ্বেষাদি- এরাই সংক্ষেপে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বিকার।৬-৭

হে অর্জুন, অমানিতা, সহিষ্ণুতা, শুদ্ধি, সরলতা, অহিংসা, গুরুসেবা, স্থিরতা, বিষয়ে বৈরাগ্য, অহংকার, শূন্যতা জন্ম-মৃত্যু, জরা-ব্যাধি ও দুঃখে দোষ ধরা, সংসারে অনাসক্তি, নিঃস্পৃহতা, শুভ-অশুভ সমজ্ঞান, মনের একনিষ্ঠা, নির্জনে বাস, সঙ্গ পরিত্যাগ, আমার প্রতি ভক্তি, কর্তৃত্ত্বাভিমান ত্যাগ, মোক্ষ সম্বন্ধে এরা জ্ঞান।৮১২

যা হতে অমৃতত্ত্ব, যিনি জ্ঞেয়, তিনি পরম ব্রহ্ম, অনাদি এবং নিত্য সনাতন।১৩

তাঁর হস্ত পদ কর্ণ সর্বব্যাপী। সর্বত্র তাঁর নয়ন। তিনি সর্বব্যাপী।১৪

তিনি নিঃসঙ্গ অথচ আধার স্বরূপ। তিনি সগুণ অথচ নির্গুণ।১৫

তিনি চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন। তিনি সূক্ষ ও অধিজ্ঞেয়। তিনি বিষয়ে থেকেও দূরে আছেন।১৬

তিনি সর্বভূতে অবিভক্ত থেকেও ভিন্ন। তিনি বিশ্বের সৃষ্টকর্তা ও সংহার কর্তা।১৭

ব্রহ্ম অন্ধকারের ঊর্ধ্বে। তিনি জ্যোতিষ্কের জ্যোতি। জ্ঞানের দ্বারাই তাঁকে জানতে হয়। তিনি সকলের হৃদয়েই বিদ্যমান আছেন।১৮

ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয় সম্বন্ধে তোমাকে বললাম। এটি জেনে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়।১৯

প্রকৃতিকে ও পুরুষকে অনাদি বলে জানবে। এই তিন জানতে পারলে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়। বিকারাদি প্রকৃতি গুণ।২০

প্রকৃতি কার্য-কারণের কারণ। আর সুখ-দুঃখ ভোগের কারণ পুরুষ।২১

পুরুষ প্রকৃতির গুণ ভোগ করেন এবং সেই গুণের প্রভাবে ভালো বা মন্দ জন্ম লাভ করে।২২

পরমেশ্বর স্রষ্টা, কর্তা ও ভোক্তা। তিনি পরমাত্মারূপে সকলের শরীরে বিরাজমান আছেন।২৩

যে ব্যক্তি প্রকৃতি ও পুরুষকে জানতে পারে, তার জন্ম হয় না।২৪

কর্মযোগে, জ্ঞানে, ধ্যানে, বুদ্ধিতে কিংবা শুদ্ধচিত্তে আত্মাকে দর্শন করা যায়।২৫

অজ্ঞান ব্যক্তি অন্যের মুখে শুনেও যদি পরমেশ্বরের উপাসনা করে তথাপি শ্রদ্ধার বলে সে মৃত্যুভয় হতে রক্ষা পায়।২৬

হে অর্জুন, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যোগে স্থাবর জঙ্গমাদি জন্মে থাকে।২৭

পরমেশ্বর সর্বভূতে বিরাজ করছেন। নিত্য ও নশ্বরকে যে সমানভাবে দেখে সে-ই প্রকৃতপক্ষে দেখে।২৮

পরমেশ্বর সর্বত্র সমান- এই জ্ঞান যাঁর আছে তিনি আত্মহিংসা হতে মুক্ত হয়ে উত্তম গতি প্রাপ্ত হন।২৯

প্রকৃতিই সমস্ত কাজ করিয়ে থাকেন- জানতে পারলে অকর্তা আত্মাকে দেখা যায়।৩০

আত্মা এক, কিন্তু তাঁর ভূতভাব ভিন্ন। এটি জানলে ব্রহ্মলাভ হয়ে থাকে।৩১

হে অর্জুন, আত্মা অনাদি, অনন্ত ও অব্যয়। দেহে তিনি কর্তা নন, সেখানে তিনি নিষ্ক্রিয় ও নির্লিপ্ত।৩২

সূর্য যেমন আকাশে থেকেও আকাশে লিপ্ত থাকে না, আত্মাও সেইরূপ দেহে থাকলেও দেহে লিপ্ত থাকে না।৩৩

এক সূর্য যেমন সমস্ত জগতকে আলোকিত করে, এক আত্মাও সেইরূপ সকলের দেহকে প্রকাশিত করেন।৩৪

জ্ঞানের বলে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের ভেদ এবং জীবের প্রকৃতি জানতে পারলে মোক্ষ লাভ হয়ে থাকে।৩৫

* ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত *

মন্তব্যসমূহ